
মোঃ আব্দুল মালেক রাজশাহী
রাজশাহী মহানগরীর বোয়ালিয়া থানা এলাকায় এক চাঞ্চল্যকর ঘটনায় স্থানীয় রাজনীতিতে যুক্ত কতিপয় যুবকের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি, লুটপাট, শ্লীলতাহানি এবং ব্ল্যাকমেইল-এর অভিযোগ উঠেছে। গত শুক্রবার (১৪ নভেম্বর) মধ্যরাতে মহানগরীর টিকাপাড়া বাসার রোডস্থ একটি বাসায় আপত্তিকর অবস্থায় এক আলিফ নামের এক যুবক ও যুবতীকে আটকের পর পুলিশে না দিয়ে তাদের কাছ থেকে চাঁদা দাবি ও লুটপাট করা হয়।
এই ঘটনায় শনিবার (১৫ নভেম্বর) ভুক্তভোগীর বড় ভাই অমিত হাসান বাদী হয়ে বোয়ালিয়া মডেল থানায় ৯ জনের বিরুদ্ধে লুটপাট, চুরি ও চাঁদাবাজির মামলা দায়ের করেছেন। মামলা নং ১৬, ১৫/১১/২৫।
মামলার অভিযুক্তরা হলেন, আলী সে বোয়ালিয়া থানাধীন খরবোনা নদীরধার এলাকার বাসিন্দা, দ্বীপ কুমার (১৮) সে বাসার রোড এলাকার মানিকের ছেলে, মো: তারেক (৩২) সে একই এলাকার মুন্সি আবুল খায়ের এর ছেলে, বিশাল (২৮), পাভেল (৩২), ঝদ্বিক (২৩), সাগর (৩২) উভয়ের বাসা বোয়ালিয়া থানাধীন বাসাররোড এলাকার বাসিন্দা, মোঃ সম্রাট (৩২) সে তালাইমারী এলাকার মৃত নজরুল ইসলামের ছেলে।
এ মামলায় এখন পর্যন্ত দ্বীপ কুমার ও বুবাই নামের দুইজনকে আটক করে বিঙ্গ আদালতে প্রেরণ করা হয়েছে।
রোববার (১৬ নভেম্বর) দুপুরে এ তথ্য নিশ্চিত করেন বোয়ালিয়া মডেল থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) আবুল কালাম আজাদ।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে—
খরবোন নদীরধার এলাকার আলী, তিনি বোয়ালিয়া থানা পূর্ব সেচ্ছাসেবক দল এর আহ্বায়ক
বাসার রোড এলাকার তারেকের নামে বোয়ালিয়া মডেল থানায় একাধিক, ব্ল্যাকমেইল ও চাঁদাবাজির মামলা রয়েছে।
তালাইমারী এলাকার সম্রাটের নামে মাদক, ছিনতাই ও চাঁদাবাজির মামলা রয়েছে।
বাসার রোড এলাকার মানিকের ছেলে দ্বীপ কুমারের বিরুদ্ধে সোনার চেইন প্রতারণা অভিযোগ রয়েছে।
এই প্রোফাইলগুলো থেকেই বোঝা যায়—এটি কোনো আকস্মিক উত্তেজনার ঘটনা নয়; বরং সংগঠিত অপরাধ–চক্রের অংশ।
বাদী অমিত হাসান তার এজাহারে ভয়াবহ ঘটনার বিবরণ দিয়েছেন, যেখানে অবৈধ অনুপ্রবেশ, চাঁদাবাজি এবং যৌন হয়রানির অভিযোগ রয়েছে:
অবৈধ প্রবেশ ও হুমকি: শনিবার আনুমানিক রাত ১টার দিকে অভিযুক্তরা জোরপূর্বক টিকাপাড়া বাসার রোডস্থ ৩য় তলার একটি বাসায় প্রবেশ করে। তারা ভাড়াটিয়া ফুলতান বেগমের কাছে ‘অবৈধ ব্যবসা’-র অভিযোগ তুলে চাঁদা দাবি করে।
লুটপাট ও শ্লীলতাহানি: এসময় তারা ভাড়াটিয়ার ৫ আনা ওজনের একটি সোনার চেইন এবং একটি রিয়েলমি সি৩৭ মডেলের ফোন, লিফান কেপিআর ১৫০ সিসি মোটর-বাইক লুট করে নেয়। এরপর অভিযুক্ত সম্রাট জোরপূর্বক ভাড়াটিয়ার মেয়েকে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা করে। মেয়েটি রাজি না হওয়ায় তার জামা-কাপড় ছিঁড়ে শ্লীলতাহানি করা হয় এবং মেয়েটার তলপেটে জোরে লাথি মেরে আহত করা হয়।
ব্ল্যাকমেইল: এরপর অভিযুক্তরা বাদীর ছোট ভাই আলিফ (২৮) এবং ভাড়াটিয়ার ছোট মেয়েকে পাশের রুমে নিয়ে গিয়ে জোরপূর্বক আলিফের কাপড় খুলে ভিডিও রেকর্ড করে। সেই ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছেড়ে দেওয়ার হুমকি দিয়ে ৫ লক্ষ টাকা চাঁদা দাবি করা হয়।
আলিফ (২৮) এবং তার ভাই অমিত হাসান (৩০) উভয়েই মহানগরীর বোয়ালিয়া থানাধীন টিকাপাড়া এলাকার মঞ্জুর হোসেনের ছেলে।
সরেজমিন অনুসন্ধানে এবং একাধিক এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এজাহারের ঘটনাটির পেছনে একটি ভিন্ন চিত্র রয়েছে।
শুক্রবার মধ্যরাতে মহানগরীর টিকাপাড়া বাসার রোডস্থ এলাকার সেই ৩ তলা বাসায় আলিফ নামের সেই যুবক ও এক যুবতীকে আপত্তিকর অবস্থায় আটক করে তারেক, আলীসহ আর ৮/৯ জন যুবক। তবে সেই যুবক ও যুবতীকে পুলিশে না দিয়ে, তারা নিজেদের মধ্যে দরকষাকষি করে, চালানো হয় লুটপাট। এরপর আলোচনার মাধ্যমে টাকা দিতে রাজি হলে সেই যুগলকে ছেড়ে দেওয়া হয়।
এছাড়াও, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া একটি ভিডিওতে আলিফ ও এক যুবতীর আপত্তিকর দৃশ্য দেখা যাওয়ার বিষয়টি এই ব্ল্যাকমেইল-এর অভিযোগকে আরও জোরালো করেছে। অর্থাৎ, অভিযুক্তরা আইনের হাতে তুলে না দিয়ে নিজেদের হাতে ‘বিচার’ তুলে নিয়েছিল এবং একে চাঁদাবাজির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছিল।
সমাজে এমন কর্মকাণ্ডের প্রভাব
এই ধরনের ঘটনা সমাজে চরম অস্থিরতা ও নৈতিক অবক্ষয়ের সৃষ্টি করে।
বিচারহীনতার সংস্কৃতি: রাজনৈতিক পরিচয় ব্যবহার করে অপরাধ করা এবং আপত্তিকর দৃশ্য ধারণ করে ব্ল্যাকমেইল করার ঘটনা প্রমাণ করে যে কিছু ব্যক্তি নিজেদের আইনের ঊর্ধ্বে মনে করে। আইন প্রয়োগের পরিবর্তে নিজেদের হাতে ‘আইন’ তুলে নিয়ে চাঁদাবাজি করার এই প্রবণতা সমাজে বিচারহীনতার সংস্কৃতিকে আরও শক্তিশালী করে।
রাজনৈতিক লেবাসে অপরাধ: অভিযুক্তদের মধ্যে স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতা আলী ও বহিস্কৃত নেতা তারেক এর উপস্থিতি প্রমাণ করে যে, রাজনৈতিক লেবাসে একটি গোষ্ঠী সমাজের নৈতিক স্খলনকে পুঁজি করে অর্থনৈতিক ফায়দা লুটছে। এটি রাজনীতির ওপর সাধারণ মানুষের আস্থা কমিয়ে দেয়।
নিরাপত্তা ও নৈতিক অবক্ষয়: এই ঘটনা সমাজের দুর্বলতা ও নিরাপত্তাহীনতাকে প্রকট করে তোলে। ব্যক্তিগত জীবনের গোপনীয়তা লঙ্ঘন করে ভিডিও ধারণ ও ব্ল্যাকমেইল করা আধুনিক সমাজে নৈতিক অবক্ষয়ের চূড়ান্ত উদাহরণ।
আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দ্রুততম সময়ে বাকি অভিযুক্তদের গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় আনবে এবং এই ব্ল্যাকমেইল চক্রের নেপথ্যের মদদদাতাদের খুঁজে বের করবে—এমনটাই আশা করছে রাজশাহী মহানগরীর সচেতন মহল।
16/11/25